নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনে প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন, আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ, নির্যাতন-হত্যা সহ নির্বাচনের আগে টাকা বিতরণের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় বেশ শঙ্কার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন স্থানীয় ভোটাররা। ভোটের দিন যত ঘনিয়ে আসছে ভোটারদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তত বাড়ছে। কারণ এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শাহজাহান ভূইয়া নির্বাচনী মাঠে রয়েছে। সেই সাথে নতুন করে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার। ফলে নির্বাচনী সময়ে হামলা-মামলা ও সংঘর্ষের শঙ্কা রয়েছে।
এদিকে গত ২২ ডিসেম্বর রূপগঞ্জে নির্বাচনী প্রচারণার সময় তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী ও দলটির মহাসচিব অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, রূপগঞ্জের কাঞ্চনে গতকাল (বৃহস্পতিবার, ২১ ডিসেম্বর) সরকারি দলের নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি হয়েছে, দেশি-বিদেশি অস্ত্র নিয়ে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়েছে। আমরা এতে খুব সন্দিহান হয়ে পড়েছি।
তিনি আরও বলেন, আমার পোস্টার ফেস্টুন যেখানে লাগাই সেখানেই রাতে গিয়ে ছিড়ে ফেলে। আমি এসপি সাহেবকে বিষয়টি জানিয়েছি। তিনি বলেছেন ব্যবস্থা নেবেন। দেখি কি ব্যবস্থা নেবেন তিনি।
জানা গেছে, গত ২১ ডিসেম্বর রাতে রূপগঞ্জের কাঞ্চন বাজার এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় ১০ জন আহত হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ অভিযান পরিচালনা করে করে আট জনকে আটক করেছে। এরা সবাই বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কাঞ্চন পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রসূল কলির সঙ্গে কাঞ্চন পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আব্দুর রহিম লিটুর দীর্ঘদিন ধরেই বিরোধ চলে আসছিল। প্রায় সময় তাদের দুই গ্রুপের লোকজনের মাঝে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে আসছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নৌকা প্রতীকের পক্ষে প্রচার-প্রচারণায় উভয় পক্ষ মাঠে রয়েছে। উভয় পক্ষ পেশি শক্তি দেখাতে এবং নিজ নিজ দলের লোকজনের সংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্যে এক অপরকে বিভিন্ন কৌশলে নিজ দলে ভিড়াচ্ছেন। এ সব বিষয় নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে চরম দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। এর ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার রাতে আব্দুর রহিম লিটুর লোকজন রামদা, চাপাতি, চাইনিজ কুড়াল সহ বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্য গোলাম রসুল কলির ছোট ভাই নূর হোসেনের মালিকানাধীন কাঞ্চন বাজারে অবস্থিত মুসলিম সুইটস এন্ড হোটেল নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। এ সময় পুরো বাজার এলাকায় ব্যবসায়ী এবং ক্রেতাদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ব্যবসায়ীরা দোকানপাট বন্ধ করে বাজার এলাকা ত্যাগ করে চলে যান। এক পর্যায়ে গোলাম রসুল কলির লোকজন এসে প্রতিবাদ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
এর আগে, নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী এবং বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর বাসভবনে ভুরিভোজ করিয়ে টাকা বিতরণ করার একটি ভিডিও প্রকাশ করেছেন তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব ও ওই আসনের প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার। এতে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার ব্যাপারে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
ভিডিও প্রসঙ্গে তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, ‘মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর বাসভবনে শুক্রবার ভুরিভোজের সময়ে সেখানে উপস্থিত প্রত্যেককে এক হাজার করে টাকা দেওয়া হচ্ছে। মন্ত্রী গাজীর পক্ষ থেকে তার অনুসারী ও জেলা পরিষদের সদস্য আনসার আলী প্রকাশ্যে এই টাকা বিতরণ করছেন। যদি এভাবে টাকা বিলি করা হয়, তাহলে এটা আচরণবিধি লঙ্ঘন হয়েছে। এভাবে টাকা বিতরণ করে প্রভাব বিস্তার করলে সুষ্ঠু নির্বাচন করার বিষয়টি নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়। প্রার্থীদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি তৈরি হয়। এই বিষয়ে জেলা নির্বাচন কমিশন কে জানিয়েছি। মূলত গাজী সাহেবের গণবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে তার নির্বাচনী অবস্থা দূর্বল দেখে তিনি এখন টাকার বিনিময়ে ভোট কিনছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত করতে নির্বাচন কমিশন তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
এছাড়া গত ৮ ডিসেম্বর রাতে রূপগঞ্জে নির্বাচনী প্রতিহিংসার জেরে স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহজাহান ভূইয়ার কর্মী-সমর্থকদের বাড়িতে হামলা ও লুটপাট সহ মারধরের অভিযোগ উঠেছে। উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের চনপাড়া পূনর্বাসন কেন্দ্রের ২ নম্বর ওয়ার্ডে দফায় দফায় এ হামলার ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর থেকে আতংকে আছেন চনপাড়ার এ ওয়ার্ডের বাসিন্দারা।
শাহজাহান ভূইয়ার কর্মী ও ভুক্তভোগী আওলাদ হোসেন জানান, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান ভূঁইয়ার পক্ষে নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা চালিয়ে আসছেন তিনি ও তার নিকট আত্মীয়-স্বজনরা। এতে তাদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সরকার দলীয় প্রার্থী বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সমর্থক কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সমশের আলী এবং তার লোকজন। এর জের ধরে শুক্রবার (৮ ডিসেম্বর) রাতে ইউপি সদস্য শমসেরের নেতৃত্বে ২০/২৫ জন লোক অতর্কিতভাবে তার বাড়িতে হামলা করে। এসময় হামলাকারীরা হাতুড়ি ও শাবল দিয়ে চারটি বাড়ির দেওয়াল, দরজা ও জানালা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। ঘরের আসবাবপত্র ও মূল্যবান সামগ্রী লুটপাটের পর বাড়ির ইট পর্যন্ত খুলে নেয় তারা। বাড়ির লোকজন বাধা দিলে হামলাকারিরা অন্তঃসত্ত্বা নারীসহ সবাইকে মারধর করে। এভাবে তার বাড়ির পাশাপাশি তার তিন আত্মীয় নুরুন নাহার, ওমর ফারুক খাজা ও সামছুন্নাহারের বাড়িতে একে একে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। এই ঘটনায় থানায় লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। আর হামলাকারী ওই শমসের স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর লোক হিসেবে পরিচিত।
এদিকে রূপগঞ্জে নামমাত্র মূল্যে বসতভিটা বিক্রি না করায় রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম ও তার ভাই মিজানুর রহমানের নির্দেশে শিশু হত্যার অভিযোগ উঠে। গত ১৫ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবের মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ হলে এক সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগী পরিবার এই অভিযোগ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে নিহত শিশু স্বাধীনের বাবা শাহিনুর রহমান শাহীন বলেন, গত ৪ ডিসেম্বর ইদারকান্দি গ্রামে নির্মাণাধীন সেতুর নিচে বালু নদী থেকে ৯ বছরের একটি শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। আমি সেই শিশুর হতভাগ্য পিতা। আমার অবুঝ সন্তানের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না, তাকে নৃশংসভাবে খুন করে লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। মরদেহ যাতে শনাক্ত না হয় এজন্য থেঁতলে দেওয়া হয় তার মুখ, অ্যাসিডে ঝলসে দেওয়া হয় শরীর। রফিক এলাকায় প্রভাবশালী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে রূপগঞ্জ থানায় পুলিশ হত্যা মামলা না নিয়ে অপমৃত্যুর মামলা করার পরামর্শ দিয়েছে।
চলতি বছরের ২১ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে জমিসংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতার ছেলের দেওয়া আগুনে পুড়ে বিউটি বেগম নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিউটি বেগম মারা যান এবং আগুনে বিউটি বেগমের মেয়ে শিমু আক্তারও দগ্ধ হয়েছেন।
জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে রূপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান ওরফে হারেজের সঙ্গে একই এলাকার জমি ব্যবসায়ী জাহের আলীর জমিসংক্রান্ত বিরোধ চলছে। এর জেরে সোমবার সকালে দুই পক্ষের মধ্যে ঝগড়া হয়। ঝগড়ার একপর্যায়ে হাবিবুর রহমান ও তাঁর ছেলে মো. মতিন মারধরের শিকার হন। ঝগড়ার সময় বিউটি বেগমের ছেলে বেলায়েত হোসেন জাহের আলীর পক্ষ নেন। এতে হাবিবুর রহমানের আরেক ছেলে মো. জুয়েল দেশি অস্ত্রসহ কয়েকজন লোক নিয়ে বিউটি বেগমের বাড়িতে হামলা চালিয়ে বাড়িঘর ভাঙচুর করে তাঁর ঘরের দড়জায় আগুন দেন। আগুন ঘরের পাশে থাকা রান্নাঘরে ছড়িয়ে পড়লে বিউটি বেগম দগ্ধ হন। তাঁকে উদ্ধার করতে গিয়ে বিউটি বেগমের মেয়ে শিমু আক্তারের হাত ঝলসে যায়। পরে আশপাশের লোকজন এসে বিউটি বেগম ও শিমু আক্তারকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
এদিকে ভোটাররা বলছেন, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পছন্দের প্রার্থীদের পক্ষে প্রকাশ্যে কাজ করতে বা সমর্থন দিতে পারছিনা। কারণ স্থানীয় সন্ত্রাসী ও ক্যাডাররা বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষ নিয়ে মাঠে নেমেছে। ফলে এক ধরনের ভয়-ভীতি কাজ করছে। তাছাড়া নির্বাচনের সময়ে সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ থাকবে বলে মনে হচ্ছেনা। ফলে যে কোন সময়ে রূপগঞ্জে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হতে পারে।