কথায় কথায় আল্লাহর নামে শপথ করা খুব বাজে স্বভাব। শপথ করলে তা অবশ্যই পূরণ করতে হয়। আল্লাহতায়ালা অসীম দয়ালু। তার তওবার দরজা বান্দার জন্য সব সময় খোলা। তাই শপথ ভঙ্গ করলে কায়মনে তাওবা করুন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তওবা কবুল করবেন। আর কোন কারনে কসম বা শপথ ভঙ্গ বা পূর্ণ না করলে বা পূরণ করতে না পারলে ‘কাফফারা’ আদায়ের সুযোগ রেখেছে ইসলাম।
শপথ দুই প্রকার।
(১) আল্লাহ তাআলার কোন সৃষ্টি নিয়ে শপথ করা : যেমন—কাবা শরীফ, নবী, আমানত, জীবন, প্রতিমা অথবা আউলিয়া। এ প্রকার শপথ হারাম ও র্শিক।
(১) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী:
ألا إن الله ينهاكم أن تحلفوا بآبائكم فمن كان حالفا فليحلف بالله أو ليصمت. (رواه البخاري رقم الحديث
“শুনে রাখ; আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে বাপ-দাদার নামে শপথ করতে নিষেধ করেছেন। তোমাদের কেউ শপথ করলে আল্লাহর নামেই করবে অথবা নীরবতা অবলম্বন করবে।”
(২) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :
من حلف بغير الله فقد أشرك (رواه أبو داؤد . رقم الحديث
যে ব্যক্তি গাইরুল্লাহর নামে কসম করল সে র্শিক করল। এ ধরনের হারাম কসম ভঙ্গ করলে কোন কাফফারা নেই। কেননা গাইরুল্লাহর নামে শপথ করা শিরক। আর তা ভঙ্গ করা তাওহীদ। এ কারণেই যে ব্যক্তি গাইরুল্লাহর নামে শপথ করে তার তওবা করা উচিৎ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : যে ব্যক্তি লাত ও উয্যার শপথ করল তার বলা উচিৎ –
لا إله إلا الله
তাছাড়া আল্লাহ তাআলার নাম ও সিফাতসমূহের সম্মান রক্ষার্থে তার নামে কসম করে ভঙ্গ করলে কাফফারা দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে অন্য কোন বস্তু তার সমকক্ষ নয়।
(২) আল্লাহ তাআলার নাম ও সিফাতের শপথ করা।
এটি চার প্রকার।
(ক) শপথের ইচ্ছা ব্যতীত এমনিতেই لا والله ( না, আল্লাহর কসম) بلى والله (হ্যাঁ, আল্লাহর কসম) মুখে উচ্চারণ করা।
এ প্রকারের কসম নিরর্থক। এর কারণে কোন কিছু লাযিম হয় না। তবে আল্লাহর মহত্ত্বের প্রতি লক্ষ্য করে এ থেকেও পরহেয করা উচিৎ।
ইরশাদ হচ্ছে :—
لَا يُؤَاخِذُكُمُ اللَّهُ بِاللَّغْوِ فِي أَيْمَانِكُمْ وَلَكِنْ يُؤَاخِذُكُمْ بِمَا عَقَّدْتُمُ الْأَيْمَانَ (المائدة:৮৯)
“আল্লাহ তাআলা কসমের ক্ষেত্রে নিরর্থক কসমের জন্য তোমাদের পাকড়াও করবেন না কিন্তু তিনি তোমাদেরকে ঐ কসমসমুহের জন্যে পাকড়াও করবেন যে গুলোকে তোমরা দৃঢ় কর।” (সুরা মায়েদাহ :৮৯)
(খ) অতীতকালীন কোন বিষয়ের ব্যাপারে সত্য মনে করে কসম করা। পরে দেখা গেল বিষয়টি উল্টো। এটি নিরর্থক।
(গ) অতীতের কোন বিষয়ে জেনে শুনে মিথ্যা কসম করা। এটি সম্পূর্ণ হারাম। এটিকে يمين غموس বলা হয়। এ ব্যাপারে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। এটি কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত।
আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমার রা. বলেন : এক ব্যক্তি নবী করীম সা. এর দরবারে এসে জিজ্ঞেস করলেন কবীরা গুনাহসমূহ কি কি ? রাসুল সা. কবীরা গুনাহের বর্ণনা করতে গিয়ে يمين غموس -কে তার মাঝে শামিল করেছেন।
লোকটি يمين غموس সম্পর্কে জানতে চাইলে রাসূল সা. বললেনঃ এটি হচ্ছে মিথ্যা কসম করে অপর মুসলিমের সম্পদ দখল করা।
এ কসমের কোন কাফফারা নেই। এটি এমন অপরাধ যা তওবা ব্যতীত শুধুমাত্র কাফফারার মাধ্যমে মিটে যায় না। যে ব্যক্তি এমন করবে, তাকে তওবা করতে হবে।
(ঘ) ভবিষ্যতের কোন সম্ভাব্য বিষয়ে ইচ্ছকৃতভাবে শপথ করা। একে يمين منعقدة বলা হয়। এ ধরণের শপথের ক্ষেত্রেই কাফফারা ওয়াজিব হয়। তবে তিনটি শর্ত সাপেক্ষেঃ
(১) শপথকারী মুসলমান, বালেগ ও বিবেকসম্পন্ন হওয়া।
(২) নিজ ইচ্ছায় কসম করা। অতএব, বাধ্য হয়ে কসম করলে কাফফারা দিতে হবে না।
(৩) ইচ্ছা করে কসম ভঙ্গ করা। অতএব, বাধ্য হয়ে অথবা ভুলক্রমে কসম ভঙ্গ করলে কাফফারা ওয়াজিব হবে না।
উল্লেখিত তিনটি শর্ত পাওয়া গেলে কাফফারা ওয়াজিব হবে। ইরশাদ হচ্ছে:—
لَا يُؤَاخِذُكُمُ اللَّهُ بِاللَّغْوِ فِي أَيْمَانِكُمْ وَلَكِنْ يُؤَاخِذُكُمْ بِمَا عَقَّدْتُمُ الْأَيْمَانَ (المائدة:৮৯)
“আল্লাহ তাআলা কসমের ক্ষেত্রে নিরর্থক কসমের জন্য তোমাদের পাকড়াও করবেন না কিন্তু তিনি তোমাদেরকে ঐ কসমসমুহের জন্যে পাকড়াও করবেন যেগুলো তোমরা দৃঢ় কর।” (সুরা মায়েদাহ :৮৯)
শপথ ভঙ্গের বিধান
যে ব্যাপারে কসম করা হয়, সেটির উপর ভিত্তি করে কসম ভঙ্গের হুকুমও বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে।
(১) শপথ ভঙ্গ করা ওয়াজিব:
যেমন কোন ব্যক্তি ওয়াজিব ছেড়ে দেয়া অথবা হারাম কাজ করার শপথ করলে তা ভঙ্গ করা ওয়াজিব। এমতাবস্থায় সে ব্যক্তি শপথ ভঙ্গ করে ওয়াজিব পালন করবে এবং হারাম কাজ থেকে ফিরে থাকবে। এবং কসমের কাফফারা আদায় করবে। যেমন- কেউ যদি মসজিদে গিয়ে জামাআতে সালাত আদায় না করার শপথ করে, তার শপথ ভঙ্গ করে জামাআতে সালাত আদায় করা ওয়াজিব। সাথে সাথে কসমের কাফফারা আদায় করবে। অথবা কোন যুবক ধুমপান না করার কারণে বন্ধুরা তাকে তিরস্কার করতে লাগল। ফলে সে ধুমপান করার উপর শপথ করল। এমতাবস্থায় শপথ ভঙ্গ করে ধুমপান করা থেকে বিরত থাকবে এবং কাফফারা আদায় করবে।
(২) শপথ ভঙ্গ করা মুস্তাহাব:
যখন কোন একটি মুস্তাহাব ছেড়ে দেয়ার অথবা মাকরূহ কাজ করার কসম করে, তখন কসম ভঙ্গ করে কাফফারা আদায় করা মুস্তাহাব। যেমন – কোন ব্যক্তি আজকের দিন সুন্নত সালাত আদায় না করার অথবা দাঁড়িয়ে পানি পান করার কসম করল। এমতবস্থায় মুস্তাহাব হলো কসম ভঙ্গ করে সুন্নত আদায় করা এবং বসে পান করা। আর কসমের কাফফারা আদায় করা।
(৩) শপথ ভঙ্গ করা হারাম:
কোন ওয়াজিব পালন করা অথবা হারাম ছেড়ে দেয়ার কসম করলে এমতাবস্থায় কসম ভঙ্গ করা হারাম। যেমন—কোন ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখার অথবা মিথ্যা পরিহারের কসম করল। এ ব্যক্তির জন্যে কসম ভঙ্গ করা হারাম।
(৪) শপথ ভঙ্গ করা জায়েয:
কোন একটি জায়েয কাজ করা অথবা ছেড়ে দেয়ার কসম করলে এমন কসম ভঙ্গ করা জায়েয। যেমন—কোন ব্যক্তি নির্দিষ্ট একটি বাড়ী ক্রয় করার কসম করল। এমতাবস্থায় কসম ভঙ্গ করে বাড়ীটি ক্রয় না করা জায়েয। তবে কসমের কাফফারা আদায় করতে হবে।
সর্বক্ষেত্রে নিজের জন্যে যেটা কল্যাণকর তা-ই করা উচিৎ। নবী করীম সা. বলেন :—
إذا حلفت على يمين فرأيت غيرها خيرا منها فكفر عن يمينك وأت الذي هو خير. (رواه البخاري رقم الحديث
তুমি কোন বিষয়ে কসম করার পর যদি দেখ অন্যটি আরো উত্তম তখন কসম ভঙ্গ করে ভাল কাজটি করে নিবে।
হালালকে হারাম মনে করার বিধান
যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহর পক্ষ থেকে বৈধ খাদ্য, পানীয় কিংবা পোশাক নিজের উপর হারাম করে নেয়, তাহলে এমতাবস্থায় তা হারাম হবেনা। তার কথাটি কসম হিসেবে গণ্য হবে এবং সে কাফফারা আদায় করে জায়েয বস্তুটি গ্রহন করবে। যেমন – কোন ব্যক্তি নিজের উপর দুধ হারাম করে নিলে তা তার জন্যে হারাম হবেনা। তবে তাকে কাফফারা আদায় করতে হবে।
কাফফারার বিবরণ
আল্লাহ্ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহ ও দয়ার ফলে কসমের কাফফারা নির্ধারিত হয়েছে। যার ফলে কসম করে যে কাজটি না করার কথা ছিল তা করা বৈধ হয় এবং যা করার কথা ছিল তা না করা জায়েয হয়।
কসমের কাফফারা নিম্নরূপ : (তিনটির যে কোন একটি)
(১) দশজন মিসকীনকে খানা খাওয়ানো। প্রত্যেককে অর্ধ সা চাউল ইত্যাদি দেবে।
(২) দশজন মিসকীনকে সালাত আদায় করতে পারে এতটুকু পোশাক দেয়া।
(৩) ত্র“টিমুক্ত একজন মুমিন দাস মুক্ত করে দেয়া।
কাফফারা আদায়কারী তিনটির যে কোন একটি বেছে নিবে।
যদি উল্লেখিত কোন একটি না পায় তাহলে একাধারে তিন দিন রোযা রাখবে। ইরশাদ হচ্ছে :
لَا يُؤَاخِذُكُمُ اللَّهُ بِاللَّغْوِ فِي أَيْمَانِكُمْ وَلَكِنْ يُؤَاخِذُكُمْ بِمَا عَقَّدْتُمُ الْأَيْمَانَ (المائدة:৮৯)
“আল্লাহ তাআলা তোমাদের কসমগুলোর মধ্যে অর্থহীন কসমের জন্যে পাকড়াও করবেন না। কিন্তু তিনি তোমাদেরকে ঐ কসকমসমূহের জন্যে পাকড়াও করবেন, যেগুলোকে তোমরা (ভবিষ্যত বিষয়ের প্রতি) দৃঢ় কর, (অর্থাৎ ইচ্ছাকৃত শপথ)।(সুরা মায়েদাহ :৮৯)
সুতরাং এর কাফফারা হচ্ছে দশজন অভাবগ্রস্থকে (মধ্যম ধরণের) খাদ্য প্রদান করা, যা তোমরা নিজ পরিবারের লোকদেরকে খাইয়ে থাক, কিংবা তাদেরকে (মধ্যম ধরণের) পরিধেয় বস্ত্র দান করা কিংবা একটা গোলাম বা বাঁদী মুক্ত করে দেয়া, আর যে ব্যক্তি সমর্থ না রাখে, সে একাধারে তিন দিন রোযা রাখবে। এটা তোমাদের কসমের কাফফারা।
পাঠ সারাংশ ও শিক্ষা :
(১) কোন ব্যক্তি একটি কাজ করা অথবা ছেড়ে দেয়ার কসম করল, অতঃপর কসম ভঙ্গ করতে চাইল। এমতাবস্থায় কসম ভঙ্গ করার পূর্বেও কাফফারা আদায় করতে পারবে। ধারাবাহিকতা রক্ষা করা জরূরী নয়।
(২) যে ব্যক্তি খানা খাওয়ানো ও পোশাক প্রদানের সামর্থ রাখে সে রোযা রাখলে কাফফারা আদায় হবেনা। তার রোযাগুলো নফল হিসেবে গণ্য হবে।
(৩) কোন ব্যক্তিকে তার বন্ধু কিংবা অন্য কেউ একটি ভাল কাজে কসম দিলে, তার উচিৎ কসম পূরণ করার সুযোগ দেয়া। এটি মুস্তাহাব।
(৪) কসম ভঙ্গ করলে তাড়াতাড়ি কাফফারা আদায় করা উচিৎ। কেননা ভঙ্গ করার সাথে সাথে এটি ওয়াজিব হয়ে যায়। তা ছাড়া সে পরবর্তীতে আদায় করার সযোগ না ও পেতে পারে।
(৫) আল্লাহর নামে মিথ্যা কসম করা থেকে বিরত থাকা উচিৎ।
(৬) কারণে-অকারণে বারবার কসম না করা উচিৎ।