ব্যবসায়ী সাব্বির আলম খন্দকার হত্যা মামলায় হুকুমের আসামি হয়ে কারাগারে রয়েছেন ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জাকির খান। অথচ হত্যাকাণ্ডের সময়ে জাকির খানকে ঘটনাস্থলে দেখেনি বলে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও এই মামলার ৬ নম্বর সাক্ষী হাবিব উদ্দিন। এতে চাঞ্চল্যকর এই মামলা নিয়ে নড়ে চড়ে বসেছেনে সংশ্লিষ্টরা। তবে মামলায় প্রত্যেক শুনানিতে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট সহ ডান্ডাবেড়ি পড়িয়ে প্রত্যেক শুনানিতে জাকির খানকে আদালতে তোলা হয়। এতে প্রশ্ন উঠেছে তিনি কী জঙ্গি সংগঠনের কোন নেতা নাকি দেশদ্রোহী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত রয়েছে? তাহলে কেন তাকে ডান্ডাবেড়ি পড়িয়ে আদালতে তোলা হয়। এতে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে তার সাথে এরুপ আচরণ করা হচ্ছে।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, ২০০৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি শহরের মাসদাইর এলাকায় নিজ বাড়ির অদূরে আততায়ীদের গুলিতে নিহত হন সাব্বির। সাব্বির আলম খন্দকার ছিলেন দেশের গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার অ্যান্ড ম্যানুফেকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) এর প্রতিষ্ঠাকালীন পরিচালক ও সাবেক সহ-সভাপতি। তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-আইন বিষয়ক সম্পাদক ও জেলা কমিটির সভাপতি তৈমূর আলম খন্দকারের ছোট ভাই। হত্যাকাণ্ডের পর তার বড় ভাই তৈমূর আলম বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা) আসনের তৎকালীন বিএনপি দলীয় এমপি গিয়াসউদ্দিনকে প্রধান আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। দীর্ঘ প্রায় ৩৪ মাস তদন্ত শেষে সিআইডি ২০০৬ সালের ৮ জানুয়ারি আদালতে ৮ জনকে আসামি করে চার্জশিট দাখিল করেন।
এ চার্জশিটে মামলার প্রধান আসামি গিয়াস উদ্দিনকে মামলা থেকে বাদ দেওয়ায় মামলার বাদী তৈমূর আলম খন্দকার সিআইডির দেওয়া চার্জশিটের বিরুদ্ধে ওই বছরের ২৪ জানুয়ারি আদালতে নারাজি পিটিশন দাখিল করেন।
নারাজি পিটিশনে তৈমূর আলম বলেছিলেন, ‘গিয়াসউদ্দিনই সাব্বির আলম হত্যাকাণ্ডের মূল নায়ক। গিয়াসউদ্দিন ও তার সহযোগীদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা একটি গোঁজামিলের চার্জশিট দাখিল করেছেন। পরবর্তীতে আদালত মামলাটি পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন।’
এরপর থেকে ৫ বছরের অধিক সময় ধরে নারায়ণগঞ্জ বিচারিক হাকিম আদালতে (ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট) মামলার শুনানি চলে আসছিল। গত ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে তৈমূর আলম খন্দকার আদালতে দাখিলকৃত না রাজি পিটিশনটি আবেদন করে প্রত্যাহার করে নেন। নারাজি পিটিশন প্রত্যাহারের কারণে গিয়াসউদ্দিন এখন আর মামলায় অভিযুক্ত নেই। ফলে সিআইডি ২০০৬ সালের ৮ জানুয়ারি আদালতে যে ৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছেন তার উপর ভিত্তি করেই মামলাটি পরিচালিত হচ্ছে।
এদিকে গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকা থেকে জাকির খানকে বিদেশি পিস্তলসহ গ্রেফতার করে র্যাব-১১। সেই অস্ত্র মামলায় জামিনে আছেন তিনি। তবে ব্যবসায়ী সাব্বির হত্যা মামলায় তিনি কারাগারে রয়েছেন। এছাড়া আরও একটি ফৌজদারি মামলা তার বিরুদ্ধে রয়েছে।
তবে সাব্বির হত্যা মামলাটি এখন সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। এই মামলায় ৫২ জন সাক্ষীর মধ্যে ৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কেউ জাকির খানের বিরুদ্ধে জোরালো কোন সাক্ষী দিতে পারেনি বলে আইনজীবী জানিয়েছেন। এদিকে গত ২৮ মে মামলার ৬ নম্বর সাক্ষী ও প্রত্যক্ষদর্শী হাবিব উদ্দিন জানিয়েছেন, ‘সাব্বির হত্যাকান্ডের সময়ে সেখানে জাকির খানকে তিনি দেখেন নি। এমনকি জাকির খান কে তাকে তিনি চিনেন না বলে জানিয়েছেন।’ এতে স্পষ্ট যে, জাকির খান এই হত্যাকণ্ডের সাথে জড়িত নয়।
এদিকে প্রত্যেক শুনানির সময়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট সহ ডান্ডাবেড়ি পড়িয়ে প্রত্যেক শুনানিতে জাকির খানকে আদালতে তোলা হয়। এসব কারণে তিনি ডায়াবেটিক, কিডনি জনিত জটিলতা ও হার্টের রোগ সহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। ফলে আসামি পক্ষের আইনজীবী চিকিৎসার জন্য আবেদন করেন। আদালত জাকির খানের চিকিৎসা করানোর জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আসামি পক্ষের আইনজীবী রাজীব মণ্ডল বলেন, জাকির খান অসুস্থ বিধায় তার সুচিকিৎসার জন্য আদালত কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপারকে নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ জেলা সুপার এই নির্দেশনা অমান্য করেছেন। জাকির খান ডায়াবেটিক, কিডনি জনিত জটিলতা ও হার্টের রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, শুনানির সময়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, ডান্ডাবেড়ি, হেমলেট ও হেন্ডকাফ পড়িয়ে জাকির খানকে আদালতে তোলা হয়। এতে করে তিনি আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তবে সাক্ষ্যগ্রহণের সময়ে আদালতে ডান্ডাবেড়ি খুলে দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। অথচ সেই নির্দেশনা কেউ মান্য করছেনা।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অংশ হিসেবে জাকির খানকে মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানো হয়েছে এবং তার সাথে অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন জাকির খান মুক্ত পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক ফরিদ আহমেদ। তিনি বলেন, বিএনপি থেকে ছিটকে পড়া তৈমুর আলম খন্দকার মিথ্যা মামলা দিয়ে জাকির খানকে ফাঁসিয়েছেন। এই মামলার তীব্র নিন্দা জানাই। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অংশ হিসেবে জাকির খানকে ফাঁসানো হয়েছে। অথচ এই হত্যাকান্ডের সময়ে জাকির খান থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এছাড়া কাশিমপুর কারাগারে জাকির খান অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে শুধু প্যারাসিট্যামল ওষুদ প্রদান করা হয়। এছাড়া তাকে কোন চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়না। তাছাড়া আদালতে শুনানির সময়ে তাকে ডান্ডাবেড়ি পড়িয়ে আনার ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এটা আসলেও খুব আমানবিক কাজ।
জাকির খান মুক্ত পরিষদের আহবায়ক মো. সলিমুল্লাহ করিম সেলিম বলেন, আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও জাকির খানকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছেনা। এটা খুবই অমানবিক কাজ। এ বিষয়ে জেল কর্তৃপক্ষকে সুদৃষ্টি দেওয়ার জন্য প্রতি অনুরোধ করছি ।
এ বিষয়ে জানতে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালার মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি।