বাংলাদেশের হয়ে বিশ্বকাপ জেতার স্বাদ পেয়েছিলেন যুবারা। মাশরাফী, তামিম, মুশফিক-যুগ পেরিয়ে সময়ের পালাবদলে তাদের হাতেই এখন জাতীয় দলের হাল। এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া ২০২০ যুব বিশ্বকাপজয়ী চার সদস্য হৃদয়-শরিফুল-তানজিম-তানজিদদের নিয়ে লিখেছেন মুসাহো মুকুল –
বিশ্বকাপ চার অক্ষরের এই শব্দটির বিশালতা ব্যাপক। বাঘা বাঘা দেশগুলো এ প্রতিযোগিতায় মুখোমুখি হয় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে, দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনতে। ক্রিকেটে প্রথম বিশ্বকাপের আসর বসে ১৯৭৩ সালে, নারীদের ৬০ ওভারের ক্রিকেট বিশ্বকাপরূপে। এর দুবছর পর ১৯৭৫ সালে পুরুষদের বিশ্বকাপ শুরু হয়। সময়ের বিবর্তনে ক্রিকেটে যেমন যোগ হয়েছে নতুন ফরম্যাট, তেমনি বেড়েছে বিশ্বকাপের সংখ্যাও। ক্রিকেটের বিশ্বায়নের সঙ্গে তরুণদের অন্তর্ভুক্ত করতে ১৯৮৮ সালে প্রথমবারের মতো অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ আয়োজন করে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল। ১০ বছরের বিরতি দিয়ে ১৯৯৮ সালে বসে প্রতিযোগিতাটির দ্বিতীয় আসর। ২০০৭ থেকে শুরু হয় সবচেয়ে ছোট অথচ আকর্ষণীয় সংস্করণ টি-টোয়েন্টির পুরুষদের বিশ্বকাপ। ২০০৯ থেকে নারীদেরটি। ১৯৯৮ সালের দ্বিতীয় আসর থেকে দুবছর পরপর নিয়মিতভাবে হয়ে আসছে যুবাদের এই বিশ্বকাপ। তার মধ্যে ২০২০ সালের আসরটি ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এ ভূখণ্ডের অসম্ভব ক্রিকেট পাগল ভক্তদের জন্য বিশেষ মর্যাদার। দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুমে ভারতকে ৩ উইকেটে হারিয়ে বাংলাদেশ জিতেছিল প্রথম বিশ্বকাপ। নারী-বুড়ো-যুব মিলিয়ে ওই একবারই বিশ্বজয়ের আনন্দ পেয়েছে বাংলাদেশ। কখনো কোনো শিরোপা জিততে না পারা বাংলাদেশ বৈশ্বিক ক্রিকেটে ঝান্ডা গেড়েছিল প্রথমবারের মতো। ওই আসরের প্রতিটি যুবাকে ঘিরে উন্মাদনার পাশাপাশি স্বপ্নে মত্ত হওয়াটা মোটেও অযৌক্তিক কিছু ছিল না। দেশের ক্রিকেটপাড়ায় ঘটেছিলও তাই। ঠিকমতো দাঁড়ি-মোঁচ না গজানো সেই দলের চার তারকা তানজিদ হাসান তামিম, তাওহীদ হৃদয়, শরিফুল ইসলাম ও তানজিম হাসান সাকিব। বয়স বেড়েছে এদের প্রত্যেকেরই। জুনিয়র তকমা ছেড়ে সবাই এখন সিনিয়র দলের নিয়মিত মুখ। বিশ্বকাপ দলের বাকি ১১ জনের সঙ্গে সারথী এ চারজনও বাংলাদেশ জাতীয় দলের স্পেশাল ফোর; কেননা বিশ্বকাপ জেতার অভিজ্ঞতা পুরো দলের মধ্যে আছে কেবল এ চারজনেরই।
‘আমরা যতদিন ক্রিকেট খেলব, ততদিন এটা আমাদের আত্মবিশ্বাস দেবে। একটা বিশ্বকাপ জয় হয়েছে। আমরা প্রতিটি খেলোয়াড় ব্যক্তিগতভাবে অনুভব করি যে, কীভাবে বিশ্বকাপ জিততে হয়. সেই সঙ্গে আমাদের আত্মবিশ্বাস আছে যে, বড়দের বিশ্বকাপ যেটা আছে সেটাও আমরা জিততে সক্ষম হব।’ কথাগুলো তাওহীদ হৃদয়ের মুখ থেকে বেরোলেও প্রতিনিধিত্ব করে চারজনেরই। আর ঠিক এ কারণেই তাদের ওপর প্রত্যাশার পারদও চড়া। এদের মধ্যে একমাত্র শরিফুলের আছে সিনিয়র দলের হয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতা। অস্ট্রেলিয়ায় হওয়া ২০২২ বিশ্বকাপে খেলার দরজা একরকম ভাগ্যের জেরেই খুলে গিয়েছিল শরিফুলের। সেইবার মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের জায়গায় বিশ্বকাপ দলে শেষ সময়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন শরিফুল। এ ছাড়া গত বছর ভারতে হওয়া ওয়ানডে বিশ্বকাপেও খেলেছেন এদের প্রত্যেকেই। ওই আসরে মেটাতে পারেননি প্রত্যাশা। তবে দুয়ারে যখন নাড়ছে আরও একটি ঘটন-অঘটনের বিশ্বকাপ, তাই স্বভাবতই দৃষ্টি আবদ্ধ থাকবে তানজিদ-হৃদয়-শরিফুল-তানজিমের দিকে।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের বিবেচনাতেই না থাকা তানজিদ হাসান তামিম নিজেকে চেনায় এ বছরের বিপিএল দিয়ে। সেঞ্চুরির সঙ্গে ১৩৫ স্ট্রাইকরেটে করেন ৩৮৪ রান। যা আসরের তৃতীয় সর্বোচ্চ। দল যখন টপঅর্ডার ব্যাটারদের ফর্মহীনতায় ভুগছে, সে সময় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজে ডাক পান তানজিদ। পাঁচ ম্যাচে করেন দুটি ফিফটি। খুলে যায় বিশ্বকাপের দরজা। সাতটি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ১২৬ স্ট্রাইকরেটে ২৩৭ রান পুঁজি করে বিশ্বকাপ খেলতে নামবেন তিনি। অভিজ্ঞতার ঘাটতির জন্যই বোধহয় ইনিংসের শুরুতে থাকেন চুপচাপ, তবে সময় গড়ালে খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে পারেন। ছোট তামিমের ছোট কাঁধে তাই বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ে ভালো শুরু এনে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব।
তাওহীদ হৃদয় অবশ্য তানজিদের চেয়ে আলাদা। গত দুই আসর ধরেই বিপিএলের সেরা রান সংগ্রাহক তিনি। ২০২৩ সালে ছিলেন এক নম্বরে। এ বছর ৩০ রান কম করে দুয়ে। স্ট্রাইকরেট ১৪৯। নিজেকে প্রমাণ করেছেন লঙ্কান প্রিমিয়ার লিগের শেষ আসরেও। লাল-সবুজ জার্সিতে ২২টি টি-টোয়েন্টি খেলে ফেলা হৃদয়ের স্ট্রাইকরেট ১৩২। নামের পাশে দুই ফিফটিতে রান ৪৫৪। চার নম্বরে ব্যাট করতে আসা হৃদয় শুরু থেকেই খেলতে পারেন হাত খুলে। সাম্প্রতিক সময়ে আছেন দারুণ ছন্দে। হৃদয়-খোলা ইনিংসে প্রতিপক্ষকে ডুবিয়ে দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে হৃদয়ের। স্পেশাল ফোরের মধ্যে তার কাছ থেকেই সবার প্রত্যাশা সবচেয়ে বেশি।
শরিফুল ইসলাম অবশ্য এবার বেশ দুর্ভাগা। ভারতের বিপক্ষে শেষ প্রস্তুতি ম্যাচে বোলিংয়ের সময় ফিরতি ক্যাচ নিতে গিয়ে বেকায়দায় আঘাত পান হাতে। দিতে হয়েছে ৬টি সেলাই। ইনজুরিতে থাকা তাসকিনের অবর্তমানে শরিফুলই ছিলেন মোস্তাফিজের সঙ্গে বাংলাদেশ পেস জুটির অন্যতম অস্ত্র। গত বিশ্বকাপে দলে থাকলেও মাত্র একটি ম্যাচে খেলে ছিলেন উইকেটশূন্য। বছর ঘুরে পরিণত শরিফুলের ইকোনমি নিয়ে শঙ্কায় থাকলেও মাঠে তার লড়াকু মনোভাবের ওপর বিশ্বাস রয়েছে সবার। তাই তার ইনজুরি বাড়িয়ে দিয়েছে আসরে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ।
আর ওই চ্যালেঞ্জেই নিজেকে প্রমাণের সুযোগ তানজিম হাসান সাকিবের। ২০২২ সালে শরিফুলের ভাগ্য এবার পেয়েছেন তানজিম। শেষ সময়ে সাইফের জায়গায় পেয়েছেন বিশ্বকাপ দলে সুযোগ। তার আগ্রাসী মনোভাবই কাজ করেছে দলে থাকার যুক্ত হিসেবে। মাত্র ৬টি ম্যাচ খেলে ৪ উইকেট শিকার, অভিজ্ঞতায় পিছিয়ে থাকা তানজিম এগিয়ে আছেন তীব্র জয়ের নেশায় মত্ত হওয়ার দিকে। শেষ দিকে ব্যাটটাও দারুণ চালাতে পারেন। যা বড় মঞ্চে হতে পারে ম্যাচের পার্থক্য গড়ে দেওয়ার উপাদান।
টি-টোয়েন্টি সংস্করণে আগে থেকে কাউকে ফেভারিট মানার সুযোগ নেই। নির্দিষ্ট দিনে ব্যাটে-বলে সুবাস ছড়াবে যারা, জয়ের হাসি হাসে তারাই। আর এ সুবাস ছড়াতে চাই বিশেষ কিছু করা। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের বদৌলতে শুধু সামর্থ্য দেখিয়ে এখন আর প্রতিযোগিতা জেতা কঠিন, করতে হয় বিশেষ কিছু। যা এ চারজন করেছিলেন ২০২০ সালে। চার বছর পেরিয়ে স্পেশাল ফোরের কাছে সেই বিশেষ কিছুই দেখার প্রত্যাশা দেশের কোটি ক্রিকেটপ্রেমীর।