নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের ১৭টি ওয়ার্ড কমিটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মীদের বিরোধ দৃশ্যমান হয়েছে। মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেনকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সাবেক সহসভাপতি ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা। এছাড়া আওয়ামী লীগ অফিসে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন ক্ষুব্ধ ও পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা। যদিও দলের শীর্ষ নেতাদের অনুরোধে দলীয় কার্যালয়ের তালা খুলে দিয়েছেন এবং কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের দিকে তাঁকিয়ে রয়েছেন। তবে এ বিষয়ে সুরাহা না হলে ফের আন্দোলন-প্রতিবাদ করার কথা জানিয়েছেন নেতাকর্মীরা। ফলে আওয়ামী লীগে চরম দ্বন্দ্ব বিরোধ দৃশ্যমান হয়েছে।
জানা গেছে, গত শুক্রবার বিকেলে এক সভায় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সিনিয়র সহ সভাপতি ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী মহানগরের সভাপতি আনোয়ার হোসেনকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। একই সাথে আনোয়ার হোসেনের তীব্র সমালোচনা করেন। ওই সভায় বক্তব্যের এক অংশে ক্ষোভ প্রকাশ করে মেয়র আইভী বলেন, ‘ আনোয়ার কাকা (মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি) প্রতিহিংসার মনোভাব নিয়ে এই কমিটি দিয়েছেন। তিনি দেওভোগকে বুঝিয়েছেন, উনি যা চাইবেন তা হবে এখানে। যেই দেওভোগে পূর্বপুরুষেরা নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগের, তাদের অসম্মানিত করেছনে তিনি। আজকে এখানে দাঁড়িয়ে দেওভোগের মানুষ হিসেবে তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করলাম আমি।’
ওই দিন রাতে ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী সাব্বির আলম সাগরের নেতৃত্বে নেতাকর্মীদের নিয়ে মহানগর আওয়ামী লীগ অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেয়। এ সময় সভাপতি আনোয়ার হোসেনকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে এবং তাকে ভুয়া ভুয়া বলে স্লোগান দেয়। এরপর থেকে পুরো জেলায় আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠে।
এই ঘটনার দুই দিন পর সোমবার (১৮ ফেব্রুয়ারী) দুপুরে এক সভায় নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান বলেন, পার্টি অফিসে তালা দেওয়ার বিষয়টা আমার মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে কেউ তালা দেওয়ার বিষয়টি ভালো চোখে দেখবেনা। তাদের ক্ষোভ থাকতে পারে; কিন্তু আওয়ামী লীগ অফিস শুধু আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের অফিস নয়, আওয়ামী লীগ অফিস হচ্ছে স্বাধীনতার পক্ষের সকল মানুষের অফিস। তাই তালা দেওয়ার দরকার নাই। আমরা বসে এ বিষয়ের সমাধান করবো। তিনি সবাইকে মিলেমিশে থাকার অনুরোধ করেন।
ওই দিন সন্ধ্যায় শীর্ষ দুই নেতা (নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান ও সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর) অনুরোধে পদবঞ্চিত নেতারা মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের তালা খুলে দেয়। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাকর্মীরা পদবঞ্চিতদের আশ্বাস দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
তবে এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, তালা খোলার বিষয়টি জানতে পেরেছি। আর ওয়ার্ড কমিটির কাগজ আমি কেন্দ্রে পাঠিয়েছি। এটা আমার একক সিদ্ধান্তে হয়নি। কমিটি পরিবর্তনের বিষয়ে আমি কাউকে আশ্বাস দেয়নি। অন্যদিকে মহানগর আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির মৃধা বলেন, এমপি শামীম ওসমান বলেছেন কমিটির বিষয়টি দেখবেন। যদি এ বিষয়ের কোন সুরাহা না হয়, তবে কেন্দ্রীয় কমিটিকে নালিশ করা হবে। রাজাকারপুত্র, হাইব্রিডদের কমিটিতে রাখতে কেন্দ্র কখনো বলেনি। এখন আমরা কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের দিকে তাঁকিয়ে আছি।
তিনি আরও বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ওয়ার্ড কমিটির অনুমোদন দেয় মহানগর কমিটি। আর সেই সুযোগে তারা রাজাকারপুত্র, হাইব্রিড ও বিতর্কিতদের কমিটিতে পদায়িত করেছে। এসব বিতর্কিতরা কমিটিতে থাকলে আমরা পাল্টা কমিটি দিবো। আন্দোলন চালিয়ে যাবো।
১৬ নম্বর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী সাব্বির আলম সাগর বলেন, দলের সিনিয়রদের নির্দেশে আমরা তালা খুলে দিয়েছি। প্রতিবাদ করার প্রয়োজন ছিল প্রতিবাদ করেছি। এখন কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা কেন্দ্রের দিকে তাঁকিয়ে আছি।
মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জি এম আরাফাত বলেন, তালা খুলে দেওয়া হয়েছে। আশা করছি, কমিটি নিয়ে সমস্যার সুরাহা হবে। যদি এর সুরাহা না হয়, তাহলে আমাদের প্রতিবাদ চলবে। এটাতো শুরু মাত্র।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘ওয়ার্ড কমিটির নেতাদের এতো সাহস নেই আওয়ামী লীগ অফিসে তালা দেওয়ার। পদধারী নেতাদের ইন্ধনে ও প্রশ্রয়ে ওয়ার্ড কমিটির নেতারা প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ অফিসে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। তছাড়া সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর মামা মনোয়ার হোসেন মনাকে ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি না করায় তিনি প্রকাশ্যে ক্ষোভ ঝেরেছেন এবং সমালোচনা করেছেন।
রাজনীতিক বিশ্লেষকদের মতে, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন কখনো মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বলয় আবার কখনো সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের বলয়ে ভিড় করেন। তাছাড়া ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে মেয়র আইভীর বিরোধীতা করে প্রকাশ্যে মেয়র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন আনোয়ার হোসেন। সেই সময়ে মেয়র আইভীর তীব্র সমালোচনা করেন আনোয়ার হোসেন। সেই থেকে তাদের মধ্যে এক ধরনের বিরোধ চলে আসছে। পরে নানা কারণে সেই বিরোধে আগুন জ্বলেনি। তবে এবার ওয়ার্ড কমিটি দেওয়াকে কেন্দ্র করে সেই ক্ষোভ ঝেরেছেন এবং প্রকাশ্যে মেয়র আইভী অতীতের স্মৃতিচারণ করে আনোয়ার হোসেনের সমালোচনা করেছেন।