দেশবন্ধু গোপের বাড়িতে কান্নার রোল। নারায়ণগঞ্জ শহরের নয়ামাটি এলাকার গোপবাড়ি এখন শোকস্তব্ধ। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় বাবা দীপক কুমার গোপ। পাশের ঘরে বিলাপ করছিলেন মা বিউটি ঘোষ। তাদের সান্তনা দিতে এসেছেন আত্মীয়স্বজন এবং স্থানীয় কাউন্সিলরসহ এলাকাবাসী। কোটা আন্দোলনে বেঘোরে প্রাণ হারাল ওই বাড়িরই মেয়ে রিয়া, যার বয়স হয়েছিল মাত্র সাড়ে ছয় বছর।
সাম্প্রতিক কোটা আন্দোলনে শহরের ডিআইটি এলাকায় সংঘর্ষ চলাকালে নিজেদের বাড়ির ছাদে খেলছিল শিশু রিয়া। তার বয়সটা খেলারই। গোলাগুলির শব্দে আতঙ্কিত হয়ে মেয়েকে আনতে ছাদে যান দীপক। রিয়াকে কোলে নিয়ে দৌড়ে যান সিঁড়ির কাছে। রিয়া তখন নিথর, বাবার কোলে মাথা এলিয়ে দেয়। তার মাথা থেকে রক্ত ঝরতে দেখে আঁতকে ওঠেন বাবা। রক্তাক্ত মেয়েকে কোলে নিয়েই ছোটেন ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের উদ্দেশে। অবস্থা সঙ্গিন দেখে সেখানকার ডাক্তাররা রিয়ার বাবাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে যেতে বলেন। অ্যাম্বুলেন্সে করে রিয়াকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। পাঁচ দিন পর বুধবার বেলা ১১টার দিকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে রিয়া। তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা হয় ‘গানশট ইনজুরি’। রাতেই মাসদাইর শ্মশানে দাহ করা হয় গুলিতে নিহত রিয়াকে।
দীপক কুমার গোপ একটি রড-সিমেন্টের দোকানে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন। তারা দুই ভাই নয়ামাটির নিজেদের বাড়ির চারতলায় থাকেন। তাদের বাবা দেশবন্ধু গোপ স্বর্গত। মা এবং স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে তারা থাকেন। বিয়ের পাঁচ বছর পর দীপক-বিউটি দম্পতির ঘর আলো করে আসে রিয়া। গত বছর নয়ামাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রিয়াকে ভর্তি করা হয় শিশু শ্রেণিতে। বার্ষিক পরীক্ষায় সব বিষয়ে ৯০/৯৫ নম্বর পেয়ে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিল রিয়া।
রিয়ার ছোট মা (কাকি) পপি রানী জানান, ‘শুক্রবার (১৯ জুলাই) ঠিক বিকেল সাড়ে ৫টায় রিয়ার মাথায় গুলি লাগে। আমার মেয়ে স্নিগ্ধা ও তার চাচাতো বোন রিয়া একই বয়সের। তারা প্রায় প্রতিদিনই ছাদে খেলতে যেত। সেদিনও দুজনে ছাদে খেলতে গিয়েছিল। বাইরে মারামারি ও গুলির শব্দ শুনে আমি ও রিয়ার বাবা গিয়ে তাদের দুজনকে ছাদ থেকে নিয়ে আসি। রিয়া অত্যন্ত চঞ্চল প্রকৃতির ছিল, পুরো ঘর মাতিয়ে রাখত। প্রথমবার আনার পর রিয়া আবার দৌড়ে ছাদে চলে যায়। এরপর তার বাবা তাকে কোলে করে নিয়ে আসার সময় তার মাথায় গুলি লাগে।’ বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
রিয়ার পাগলপ্রায় বাবা দীপক প্রথমে কথা বলতে রাজি হননি। ছবি তুলতে গেলে বাধা দেন। বলেন, ‘কী হবে ছবি তুলে! কী হবে কথা বলে! আমি কি আর আমার বুকের মানিককে ফিরে পাব।’ বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। কিছুক্ষণ পর এই প্রতিনিধিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আচ্ছা বলেন তো, নিজের ঘরের ছাদে যদি নিরাপদ থাকতে না পারি, আর কোথায় নিরাপদ থাকব। আমার মেয়েটা খুবই চঞ্চল প্রকৃতির ছিল। পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখত। আমার অবুঝ শিশুটা কার কী এমন ক্ষতি করল যে তাকে এভাবে মরতে হলো? ডাক্তার বলেছে, তার মাথার একদিক দিয়ে গুলি ঢুকে আরেক দিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। মাথার খুলি ভেঙে মগজ ছেদ করে গুলি বেরিয়ে গেছে। হাসপাতালের আইসিইউতে পাঁচ দিনে দুবার সে আঙুল নেড়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম হয়তো সে বেঁচে উঠবে। সব আশা শেষ হয়ে গেল।’
মামলা করবেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মামলা করে কী হবে? সংঘর্ষের মধ্যে কে গুলি করেছে, কার গুলি আমার মেয়ের মাথা ছেদ করে গেছে আমরা তো জানি না। কার বিরুদ্ধে মামলা করব?’
স্বজনরা বলেন, ‘এ কষ্ট, বেদনা ভোলার মতো নয়।’ আজ (বৃহস্পতিবার) সকালে সান্ত¡না জানাতে এসেছিলেন স্থানীয় কাউন্সিলর ও তার পিএস। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চেয়ে তারা বলেন, ‘এমন ঘটনা আর কারও সঙ্গে যেন না ঘটে এ কথাই সরকারের কাছে আমরা জানাতে চাই।’
কোটা আন্দোলনে ১৮ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত পাঁচ দিনে নারায়ণগঞ্জে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে। ছাত্রলীগ ও পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ এবং বিক্ষোভকারীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট নিক্ষেপে অন্তত ৯ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে চার শতাধিক মানুষ। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৩৪ জন সদস্যও রয়েছেন। গুরুতর আহতরা হাসপাতালে রয়েছে।
আন্দোলনের সুযোগে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ভুঁইগড়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) জেলা কার্যালয়, পাসপোর্ট অফিস, সিটি করপোরেশনের নগর ভবন, আওয়ামী লীগের কার্যালয়, পুলিশ বক্স, পুলিশ ফাঁড়ি, পুলিশের গাড়ি, নারায়ণগঞ্জ ক্লাব লিমিটেডসহ ছোট-বড় অর্ধশতাধিক স্থাপনায় ও কয়েকটি পোশাক কারখানায় ভাঙচুর চালিয়েছে এবং আগুন দিয়েছে নাশকতাকারীরা। শীতল ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের ২৬টি এসি বাসসহ আরও ২০টি বিভিন্ন ধরনের যানবাহনে আগুনও দিয়েছে তারা। জেলা শহরের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটানো হয়েছে। (দেশ রূপান্তরের সৌজন্যে)