রোববার শেষ হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নারায়নগঞ্জে দু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমূখর পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে ভোট গ্রহণ। নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেছে, নারায়ণগঞ্জ- ৪ (ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনে ১ লাখ ৯৫ হাজার ৮২৭ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ও সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান।
বিপুল ব্যবধানে জয়লাভের পর এবার প্রবাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানকে নিয়ে সর্বমহলে শুরু হয়েছে আলোচনা।
আলোচনায় উঠে এসেছে শামীম ওসমানের পরিবারের ইতিহাস। দাদা-বাবার পর এক মায়ের পেটের ৩ ভাই সংসদ সদস্য হয়েছেন এই নারায়ণগঞ্জ থেকে। জনপ্রিয়তার নিরিখে শামীম ওসমান এখানকার রাজনীতির কিংবদন্তীতুল্য। সল্প সময়ের নোটিশে লাখো লোকের সমাগম ঘটাতে পারেন নিমিষেই। রাজনীতি করতে গিয়ে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছেন। বোমা হামলায় মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন। শুধু নারায়ণগঞ্জ সারা বিশ্বে যার পরিচিতি রয়েছে একজন খাঁটি বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হিসেবে। প্রধাণমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিপুল আস্থা অর্জন করে উন্নয়নেও ব্যাপক অবদান রেখে চলেছেন এই সংসদ সদস্য। শুধু কমতি আছে মন্ত্রী সভায় স্থান নিয়ে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের পর নারায়ণগঞ্জবাসী তথা আওয়ামী লীগ ও সমমনা সকল মহলই মন্ত্রী সভায় দেখতে চাইছেন বিপুল ভোটে নির্বাচিত এমপি শামীম ওসমানকে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ৩ পুরুষ ধরে অবধান রাখা এ পরিবারটি দুই ভাই শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমান এবারও বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বিভিন্ন সময় পরিবারটির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে দেখা গেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।
শত বছর পূর্বে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমানের দাদা এম ওসমান আলী রাজনীতি শুরু করেন।
আরো পড়ুন: চতুর্থবারের মতো নির্বাচিত শামীম ওসমান
নারায়ণগঞ্জের তানজিম মুসাফিরখানা, রহমতুল্লাহ অডিটোরিয়াম ও গণপাঠাগার নির্মাণে তার অবদান ছিল। এসব জনহিতকর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাকে ১৯৪০ সালে ‘খান সাহেব’ উপাধিতে ভূষিত করে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের দমননীতির প্রতিবাদে তিনি ১৯৪৪ সালে উপাধি বর্জন করেন। ব্রিটিশদের উপাধি বর্জনের সাহসী সিদ্ধান্তের জন্যও সেসময় তিনি সমানভাবে প্রশংসিত হন। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হলে ওসমান আলী নারায়ণগঞ্জে আন্দোলনকে সংগঠিত করেন এবং বামপন্থী ও অন্যান্য স্থানীয় নেতাদের সহযোগিতায় সেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার চেষ্টা করেন। ১৯৪৬ সালে নারায়ণগঞ্জে ‘ঝুলন যাত্রা’কে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হলে হিন্দু ও মুসলমানদের সমঝোতায় আনতে তিনি ভূমিকা রাখেন। ওসমান আলী ১৯৪৬ সালে সাধারণ নির্বাচনে (নারায়ণগঞ্জ দক্ষিণ নির্বাচনী এলাকা) ঢাকার নবাব খাজা হাবিবুল্লাহকে পরাজিত করে বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি নারায়ণগঞ্জ শহর মুসলিম লিগের সভাপতি এবং ঢাকা জেলা মুসলিম লিগের সহ-সভাপতি ছিলেন। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি নারায়ণগঞ্জ শহর মুসলিম লিগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ঢাকা জেলা মুসলিম লিগে ঢাকার নবাবদের সঙ্গে প্রগতিশীল গ্রুপের মতবিরোধ দেখা দেয়। এ বিরোধে ওসমান আলী প্রগতিশীল গ্রুপকে সমর্থন করেন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে নারায়ণগঞ্জে গণসংবর্ধনা দেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য ছিলেন এম ওসমান আলী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সেসময়ের রাজনীতিবিদরা তাকে অত্যন্ত সমীহ করতেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তার বিশেষ ভূমিকা ছিল। এ জন্য তিনি কারারুদ্ধ হন। ১৯৬২ সালের শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন, ছয়দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ওসমান আলী সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
বাবার পথ ধরেই রাজনীতিতে এসে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন ওসমান আলীর বড় ছেলে একেএম সামসুজ্জোহা। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে নির্বচনে তিনি সাংসদ হন। বঙ্গবন্ধুর সাথে রাজনীতির ময়দানে থাকা সামসুজ্জোহা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। সরকারি বার্তা সংস্থা বাসসের খবরে জানানো হয়, মৃত্যুর ২৯তম বার্ষিকীতে এসে ২০১৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়।
আরো পড়ুন: ভোট দিয়ে শামীম ওসমান: ‘আকাশে শকুন উড়ছে’
সামসুজ্জোহা বেঁচে থাকতেই তার বড় ছেলে নাসিম ওসমান স্বৈরাচার এরশাদের শাসনামলে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৮৬ সালে তিনি সাংসদ হন। পরবর্তীতে ১৯৮৮, ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির টিকিটে তিনি এমপি হন।
২০১৪ সালের এপ্রিলে নাসিম ওসমানের আকস্মিক মৃত্যুতে তার আসনে সংসদ সদস্য হন সেলিম ওসমান। ২০১৮ ও ২০২৪ সালে সেলিম ওসমান ৩য় বারের মতো এমপি হলেন।
এর আগে ১৯৯৬ সালে প্রথম এমপি হন ছোট ভাই শামীম ওসমান। এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে চতুর্থ বারের মতো এমপি হয়েছেন তিনি।
চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে মন্ত্রী সভা গঠন হতে পারে বলে জানা গেছে। নারায়ণগঞ্জের মানুষ চাইছেন এবার মন্ত্রী হিসেবে শামীম ওসমানকে দেখতে।